"শেষো বহুব্রীহিঃ"(২-২-২৩) হল একটি অধিকার সূত্র। ইহার অধিকার "চার্থে দ্বন্দ্বঃ" (২-২-২৯) সূত্রের পূর্ব পর্যন্ত। "শেষো বহুব্রীহিঃ" (২-২-২৩) সূত্র হইতে "চার্থে দ্বন্দ্বঃ" (২-২-২৯) সূত্রের পূর্ব পর্যন্ত যে সমাস হয় তাহার বহুব্রীহি সমাস সংজ্ঞা হয়। "শেষো বহুব্রীহিঃ" সূত্রের ব্যাখ্যায় ভট্টোজি দীক্ষিত 'শেষ' শব্দের স্বরূপ সম্বন্ধে বলেছেন- ' "দ্বিতীয়া শ্রিতাতীত----"(২-১-২৪) ইত্যাদিনা যস্য ত্রিকস্য বিশিষ্য সমাসো নোক্তঃ স শেষঃ, প্রথমান্তমিত্যর্থঃ।' অর্থাৎ "দ্বিতীয়া শ্রিতাতীত.......", "তৃতীয়া তৎকৃতার্থেন....", "চতুর্থী তদর্থার্থ....", "পঞ্চমী ভয়েন.....," "ষষ্ঠী", "সপ্তমী শৌণ্ডৈঃ" ইত্যাদি সূত্রে 'দ্বিতীয়া', 'তৃতীয়া' প্রভৃতি বিভক্তির বিশেষ ভাবে উল্লেখ করে সমাস বিহিত হয়েছে, কিন্তু যে বিভক্তিটির বিশেষ উল্লেখ করে কোনো সমাস বিধান করা হয় নি, তাই এখানে শেষ। সুতরাং 'শেষ' বলতে প্রথমা বিভক্তিকেই বুঝতে হবে।
সূত্রে 'শেষ'-র শাব্দিক অর্থ "উক্তাদন্য শেষঃ"। অর্থাৎ যা বলা হয়নি, যা বাকী রয়ে গেছে তাই শেষ। কাশিকাকার বামন-জয়াদিত্য বলেছেন- যেখানে অন্য কোনো সমাসের বিধান হয়নি তাই শেষ এবং সেখানেই বহুব্রীহি প্রযোজ্য- 'কঃ শেষঃ? যত্রান্যঃ সমাসো নোক্তঃ।'
এখানে উল্লেখ্য, কর্মধারয় সমাসও প্রথমান্ত পদে হলেও, কর্মধারয় সমাস বিধায়ক সূত্রে 'প্রথমা' উল্লিখিত নেই। কর্মধারয় সমাস বিধায়ক সূত্রটি হল-"বিশেষণং বিশেষ্যেণ বহুলম্।" অর্থাৎ বিশেষ্যের সঙ্গে বিশেষণের সমাস হয়।
বহুব্রীহি সমাসের প্রকারভেদ :-
বহুব্রীহি সমাসে সাধারণতঃ অন্য পদের অর্থ প্রধান হয়-'অন্যপদার্থপ্রধানো বহুব্রীহিঃ।' প্রধানতঃ সমানাধিকরণ ও ব্যধিকরণভেদে বহুব্রীহি দ্বিবিধ--
১) সমানাধিকরণ বহুব্রীহি- যে বহুব্রীহিতে সমস্যমান পদের অভিধেয় একটি মাত্র হয় এবং যেখানে পদগুলি পরস্পর বোধ্য-বোধকভাবে বা আশ্রয়-আশ্রয়ী ভাবে সম্বন্ধ থাকে তাকে সমানাধিকরণ বলে। এককথায়, একাধিক প্রথমান্ত পদে বিশেষ্য-বিশেষণের বহুব্রীহি সমানাধিকরণ বহুব্রীহি। যেমন-'পীতম্ অম্বরং যস্য সঃ' পীতাম্বরঃ। এখানে 'পীতত্ব' ও 'অম্বরত্ব' অবিচ্ছিন্নভাবে একটি মাত্র আধারে পরস্পর আশ্রয়পূর্বক অবস্থান করছে বলে এরা সমানাধিকরণ হয়েছে। বিধায়ক-সূত্র--"অনেকমন্যপদার্থে।"
২) ব্যধিকরণ বহুব্রীহি- ব্যধিকরণ বহুব্রীহিতে কিন্তু সমস্যমান পদের অভিধেয় বস্তু এক নয়। যেমন- 'বীণা পাণৌ যস্যাঃ সা' বীণাপাণিঃ। এখানে বীণাত্ব ও পাণিত্ব বিভিন্ন আধারকে আশ্রয় করে ব্যধিকরণ হয়েছে।
ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সম্বন্ধে পাণিনি বিশেষ উপদেশ দেননি। বৃত্তিকারেরও মনে হয়, ব্যধিকরণ বহুব্রীহি অভিপ্রেত নয়- 'বহুব্রীহিঃ সমানাধিকরণানামিতি বক্তব্যম্।' কিন্তু ভাষাতে 'শরজন্মা', 'শাস্ত্রজন্মা', 'আত্মজন্মা' ইত্যাদি সৃষ্ট প্রয়োগ দৃষ্ট হয়। এরূপ দেখে বামনাচার্য তাঁর 'কাব্যালঙ্কারসূত্রবৃত্তি'-তে সূত্র করেছেন-'অবর্জ্যো বহুব্রীহির্ব্যধিকরণো জন্মাদ্যুত্তরপদঃ।' পরবর্তী বৈয়াকরণগণ ব্যধিকরণ বহুব্রীহির অপাণিনীয়ত্ব নিবারণের জন্য "সপ্তমীবিশেষণে বহুব্রীহৌ"-এই সূত্রের জ্ঞাপকতা স্বীকার করেছেন। দীক্ষিত বৃত্তিতে বলেছেন- 'অত এব জ্ঞাপকাদ্ ব্যধিকরণপদো বহুব্রীহিঃ।'
বাররুচসংগ্রহে বহুব্রীহি সমাসকে ছয় প্রকার বলা হয়েছে-'ষড্বিধশ্চ বহুব্রীহিঃ।' যেমন-তদ্গুণসংবিজ্ঞান, অতদ্গুণসংবিজ্ঞান, সংখ্যোত্তরপদ, অন্তরালাভিধেয়ক, সরূপোপলক্ষিত এবং সহপূর্বপদ। দৃষ্টিভেদে বহুব্রীহি আবার দ্বিবিধ হতে পারে, তদ্গুণসংবিজ্ঞান ও অতদ্গুণসংবিজ্ঞান বহুব্রীহি। চাঙ্গ সূত্রে উক্ত বিভাগ নিয়ে এই কারিকাটি দৃষ্ট হয়-'তদ্গুণোঽতদ্গুণশ্চেতি বহুব্রীহির্দ্বিধা মতঃ।'
১) তদ্গুণসংবিজ্ঞান বহুব্রীহি- যে বহুব্রীহি সমাসের শাব্দবোধে সমস্যমান পদার্থেরও উপস্থিতি হয়, তাকে তদ্গুণসংবিজ্ঞান বলে। যথা--'লম্বৌ কর্ণৌ যস্য, তম্' - লম্বকর্ণম্ আনয়। এস্থলে 'আনয়ন' ক্রিয়ার সঙ্গে এরূপ বালক এবং কর্ণ উভয়েরই অন্বয় আছে।
২) অতদ্গুণসংবিজ্ঞান বহুব্রীহি- যে বহুব্রীহিতে শাব্দবোধে সমস্যমান পদের অতিরিক্ত পদার্থের উপস্থিতি হয় তাকে অতদ্গুণসংবিজ্ঞান বহুব্রীহি বলে। যথা-'দৃষ্টঃ সমুদ্রঃ যেন'-দৃষ্টসমুদ্রম্ আনয়। এই বাক্যে 'আনয়ন' ক্রিয়ার সঙ্গে ঐ বালকের অন্বয় আছে, কিন্তু সমুদ্রের অন্বয় নেই।
যাঁরা ষড্বিধ বহুব্রীহি স্বীকার করেন,পূর্বোক্ত 'তদ্গুণসংবিজ্ঞান' এবং 'অতদ্গুণসংবিজ্ঞান' উভয়ের সঙ্গে সূত্র বিশেষ বিহিত চারপ্রকার অবান্তর বিভাগ করে থাকেন, যথা-
৩) সংখ্যোত্তরপদ বহুব্রীহি- যে বহুব্রীহি সমাসের উত্তরপদ সংখ্যাবাচক হয়, তাকে সংখ্যোত্তরপদ বহুব্রীহি বলে। যথা -'দ্বৌ বা ত্রয়ো বা-দ্বিত্রাঃ।' সূত্র-"সংখ্যয়াঽব্যয়াসন্নাদূরাধিকসংখ্যাঃ সংখ্যেয়ে।"
৪) অন্তরালাভিধেয়ক বহুব্রীহি- যে বহুব্রীহি সমাসের দুটির দিকের অন্তরাল অর্থাৎ মধ্যবর্তী দিককে নির্দেশ করা হয়, তাকে অন্তরালাভিধেয়ক বহুব্রীহি বলে। যথা-'দক্ষিণস্যাঃ পূর্বস্যাশ্চ দিশোঃ অন্তরালং' -দক্ষিণপূর্বাঃ। সূত্র- "দিঙ্নামান্যন্তরালে।"
৫) সরূপোপলক্ষিত বহুব্রীহি-পরস্পর একপ্রকার ক্রিয়ানুষ্ঠান বোঝালে সমানাকার দুটি সপ্তম্যন্ত বা তৃতীয়ান্ত পদের বহুব্রীহি সমাস হয়, তাকে সরূপোপলক্ষিত বহুব্রীহি বলে। সূত্র-"তত্র তেনেদমিতি সরূপে।" এই সমাসে "ইচ্ কর্মব্যতিহারে" সূত্রানুসারে সমাসান্ত 'ইচ্'-প্রত্যয়ের বিধান হয়। এই সমাসের নামান্তর হল 'ব্যতিহার বহুব্রীহি।' "তিষ্ঠদ্গু-----" গণপাঠে ইচ্ প্রত্যয়ের পাঠ থাকায় 'ইচ্'-প্রত্যয়ান্ত শব্দ অব্যয়ীভাব এবং অব্যয় হয়।
উদাহরণ-
ক) সপ্তম্যন্ত-'কেশেষু কেশেষু গৃহীত্বা ইদং যুদ্ধং প্রবৃত্তম্'-কেশাকেশি।
খ) তৃতীয়ান্ত- 'দণ্ডৈশ্চ দণ্ডৈশ্চ প্রহৃত্য ইদং যুদ্ধং প্রবৃত্তম্'-দণ্ডাদণ্ডি।
৬) সহপূর্বপদ-এই বিভাগকে আমরা তুল্যযোগ বহুব্রীহি ও বলে থাকি, কেননা বিধায়ক সূত্র -"তেন সহেতি তুল্যযোগে।" অর্থাৎ তুল্যযোগ বোঝালে 'তৃতীয়ান্ত' পদের সঙ্গে 'সহ' শব্দের বহুব্রীহি সমাস হয়। যথা-'পুত্রেণ সহ বর্তমানো যৎ সঃ' -সপুত্রঃ / সহপুত্রঃ।
উপরন্তু বহুব্রীহি সমাসের অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য বিচার করে বহুব্রীহি কে আরও তিন প্রকার বলা যেতে পারে।
৭) নঞ্ বহুব্রীহি- নঞ্-এর পরে অস্ত্যর্থক শব্দ থাকলে পরবর্তী সুবন্ত শব্দের সঙ্গে তার বহুব্রীহি সমাস হয়। একে নঞ্ বহুব্রীহি বলে। প্রাসঙ্গিক বার্তিক সূত্র-"নঞোঽস্ত্যর্থানাং বাচ্যো বা চোত্তরপদলোপঃ।" যথা-'অবিদ্যমানঃ পুত্রঃ যস্য সঃ'-অবিদ্যমানপুত্রঃ/ অপুত্রঃ।
৮) উপমানগর্ভ বহুব্রীহি- যে বহুব্রীহি সমাসের ব্যাসবাক্যে উপমানবোধক 'ইব' এবং উপমানের উল্লেখ থাকে তাকে উপমানগর্ভ বহুব্রীহি বলে। যথা- 'মীনস্য ইব অক্ষিণী যস্যাঃ সা'- মীনাক্ষী। সূত্র-"বহুব্রীহৌ সক্থ্যক্ষ্ণোঃ স্বাংগাৎ ষচ্।"
৯) প্রাদি বহুব্রীহি- প্র-প্রভৃতি উপসর্গের পরে ধাতু নিষ্পন্ন পদ থাকলে পরবর্তী সুবন্ত পদের সঙ্গে তার বহুব্রীহি সমাস হয় এবং ঐ ধাতুনিষ্পন্ন পদ বিকল্পে লুপ্ত হয়। যথা- 'বিগতঃ ধবঃ যস্যাঃ সা'- বিধবা /বিগতধবা। বার্তিক সূত্র- "প্রাদিভ্যো ধাতুজস্য বাচ্যো বা চোত্তরপদলোপঃ।"
পরিশেষে, আচার্য জগদীশ তাঁর 'শব্দশক্তিপ্রকাশিকা' গ্রন্থে বলেছেন-দ্বিপদ-ত্রিপদ-চতুষ্পদ ভেদে বহুব্রীহি বহুবিধ হতে পারে।
দ্বিপদ বহুব্রীহি- 'বহবঃ ব্রীহয়ঃ যস্য সঃ'-বহুব্রীহিঃ।
ত্রিপদ বহুব্রীহি- 'চিত্রা জরতী গৌঃ যস্য'-চিত্রাজরদ্গুঃ।
চতুষ্পদ বহুব্রীহি- 'দিব্যম্ অনেকম্ উদ্যতম্ আয়ুধং যস্য সঃ'-দিব্যানেকোদ্যতায়ুধঃ।
বহুব্রীহি সমাস যে বহুপদ হবে তার উল্লেখ ভট্টোজি দীক্ষিত 'সর্বসমাসশেষ' প্রকরণে করেছেন-'অনেকপদত্বং দ্বন্দ্ববহুব্রীহ্যোরেব।'
সহায়ক গ্রন্থসমূহ--
ডঃসত্যনারায়ণ চক্রবর্তী প্রণীত পাণিনীয় শব্দশাস্ত্র।
ডঃবিশ্বরঞ্জনবেদব্যাকরণতীর্থ-সম্পাদিত বৈয়াকরণসিদ্ধান্তকৌমুদী।
ডঃসচ্চিদানন্দমুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত বৈয়াকরণসিদ্ধান্তকৌমুদী (সমাসপ্রকরণ)।
লাহিড়ী-শাস্ত্রি-সম্পাদিত পাণিনীয়ম্।
___________
Ba khub valo likhecho to dada
ReplyDeleteভালো লাগলো স্যার।
ReplyDeleteBah,great...anek kaje lagbe...
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteBhalo likhecho dada ..
ReplyDeleteBhalo hoyeche Srimanta
ReplyDelete