Friday, August 28, 2020

পাঠ- অব্যয়ীভাবসমাস

'অবিদ্যমানো ব্যয়ো যস্য তদি'তি অব্যয়ম্ (নঞ্ বহুব্রীহিসমাস)। সূত্র- "নঞোস্ত্যর্থানাং বাচ্যো বা চোত্তরপদলোপঃ।"  'অনব্যয়ম্ অব্যয়ং ভবতি'-এরূপ অর্থে 'অব্যয়' শব্দের উত্তর "ঊর্যাদিচ্বিডাচশ্চ" সূত্রানুসারে অভূততদ্ভাবে 'চ্বি' প্রত্যয়ে এবং ভূ-ধাতুর উত্তর ঘঞ্ প্রত্যয় করে অব্যয়ীভাব পদটি নিষ্পন্ন হয়। অব্যয়ীভাব নামকরণের ক্ষেত্রে অব্যয়ের স্বরূপই প্রকটিত হয়েছে। যে পদ লিঙ্গ, বিভক্তি, বচন ব্যয় করে না তাকে অব্যয়ীভাব বলে। অব্যয়ীভাব সমাস নিষ্পন্ন পদ একই বিভক্তি ও একই বচনে স্থির থাকে, এদের কোনো পরিবর্তন হয় না।

অব্যয়ীভাবসমাসের বৈশিষ্ট্য :

পূর্বাচার্যগণ পদার্থের প্রাধান্যের ভিত্তিতে সমাসের চতুর্বিধত্ব স্বীকার করেছেন। তন্মধ্যে যে সমাসের পূর্বপদের অর্থ প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয় তাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলে। 'পূর্বপদার্থপ্রধানোব্যয়ীভাবঃ।' এই সমাসের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
(ক) অব্যয়ীভাব সমাসে পূর্বপদ প্রধানতঃ অব্যয় থাকে। যেমন-মক্ষিকাণাম্ অভাবঃ - নির্মক্ষিকম্। এখানে অভাব অর্থদ্যোতক 'নির্' অব্যয়ের অর্থ-ই প্রধান।

(খ) কোন কোন ক্ষেত্রে অব্যয়ীভাব সমাসে উত্তরপদের অর্থও প্রধান হয়, যেমন-শাকস্য লেশঃ-শাকপ্রতি। "সুপ্ প্রতিনা মাত্রার্থে" সূত্রানুসারে এখানে 'প্রতি' অব্যয়টি মাত্রা বা স্বল্পার্থদ্যোতক, অথচ এটি পূর্বপদে না বসে উত্তরপদে বসেছে। এটি অব্যয়ীভাবসমাসের একটি ব্যতিক্রমী স্থল।

(গ) এই সমাসের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল পূর্বপদের অর্থ প্রধান না হয়ে অন্য পদের অর্থও প্রধান হয়। চরিত্রটি বহুব্রীহিসমাসের অনুরূপ। যথা-উন্মত্তগঙ্গম্, লোহিতগঙ্গম্। সূত্র- "অন্যপদার্থে চ সংজ্ঞায়াম্।" দীক্ষিত এই ক্ষেত্রটিকে অবিগ্রহ নিত্যসমাস বলেছেন--'বিভাষাধিকারেপি বাক্যেন সংজ্ঞানবগমাদিহ নিত্যসমাসঃ।'
 
(ঘ) "বিভাষা" এই সূত্রটি অব্যয়ীভাবসমাসের বৈশিষ্ট্যকে দ্বিধামণ্ডিত করেছে। "বিভাষা" সূত্রের পূর্ববর্তী অব্যয়ীভাবসমাসগুলি নিত্য, কিন্তু পরবর্তী সমাসগুলি অনিত্য অর্থাৎ বৈকল্পিক। নিত্যের ক্ষেত্রে সমাস অবশ্য কর্তব্য, যেমন-হরৌ-অধিহরি এটি বিভক্তির উদাহরণ। বৈকল্পিক বা অনিত্য সমাসের উদাহরণ-আমুক্তি। বিগ্রহ- আ  মুক্তেঃ। এখানে সমাস না করলেও অর্থবোধের অসুবিধা হয় না।

(ঙ) অব্যয়ীভাবসমাসে অকারান্ত শব্দের উত্তর অম্ভাব হয়। সূত্র- "নাব্যয়ীভাবাদতোম্ত্বপঞ্চম্যাঃ।"  যথা-দুর্ভিক্ষম্, অনুরূপম্ ইত্যাদি।

(চ) এই সমাসে কিছু কিছু পদ নিপাতনে সিদ্ধ হয়। যেমন-'তিষ্ঠন্তি গাবো যস্মিন্ কালে (দোহায়) সঃ'-তিষ্ঠদ্গু। সূত্র-"তিষ্ঠদ্গুপ্রভৃতীনি চ।"

(ছ) অব্যয়ীভাবসমাসের অপর বৈশিষ্ট্য  হল যে, অব্যয়ীভাবসমাস নিষ্পন্ন পদ সর্বদা অব্যয় হয়। সূত্র- "অব্যয়ীভাবশ্চ।"


সহায়কগ্রন্থসূচী :
ডঃবিশ্বরঞ্জনবেদব্যাকরণতীর্থ-সম্পাদিত বৈয়াকরণসিদ্ধান্তকৌমুদী।
ডঃসচ্চিদানন্দমুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত বৈয়াকরণসিদ্ধান্তকৌমুদী (সমাসপ্রকরণ)।
লাহিড়ী-শাস্ত্রি-সম্পাদিত পাণিনীয়ম্।

Friday, August 21, 2020

পাঠ- ১: দ্বন্দ্বসমাস

দ্বন্দ্ব সমাসের প্রধান সূত্র হল-"চার্থে দ্বন্দ্বঃ।" 'চ'-এর অর্থে বিদ্যমান একাধিক সুবন্ত পদের বিকল্পে সমাস হয় এবং তা দ্বন্দ্ব। সূত্রস্থ 'চ'-এর অর্থ চারটি- সমুচ্চয়, অন্বাচয়, ইতরেতরযোগ এবং সমাহার-'সমুচ্চয়ান্বাচয়েতরেতরযোগসমাহারাশ্চার্থাঃ।'

(ক) সমুচ্চয়- পরস্পর নিরপেক্ষ একাধিক সুবন্ত পদের একবিষয়ক অন্বয়কে সমুচ্চয় বলা হয়-'পরস্পরনিরপেক্ষস্য অনেকস্য একস্মিন্নন্বয়ঃ সমুচ্চয়ঃ।' এই সমুচ্চয় আবার চার প্রকার-

অ) ক্রিয়ার সঙ্গে দ্রব্যের- ঈশ্বরং গুরুঞ্চ ভজস্ব।
আ) দ্রব্যের সঙ্গে দ্রব্যের- রাজ্ঞঃ গজশ্চ অশ্বশ্চ।
ই) দ্রব্যের সঙ্গে গুণের - পটঃ শুক্লঃ রক্তশ্চ।
ঈ) গুণের সঙ্গে দ্রব্যের- রক্তঃ পটঃ কম্বলশ্চ।

খ) অন্বাচয়- প্রধান বিষয়ের সঙ্গে আনুষঙ্গিক বিষয়ের যে একাত্ম সূচক অন্বয়, তাকে অন্বাচয় বলে-'অন্যতরস্য আনুষঙ্গিকত্বে অন্বাচয়ঃ।' যথা- 'ভিক্ষাম্ অট গাং চ আনয়' অর্থাৎ ভিক্ষায় যাও, পথে  গুরুটি দেখতে পেলে আন।

গ)  ইতরেতরযোগ- পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত একাধিক সুবন্ত পদ একই ক্রিয়ার সঙ্গে যুগপৎ অন্বিত হলে এবং প্রত্যেক পদে পৃথক্ প্রাধান্য থাকলে ইতরেতর যোগ হয়। 'মিলিতানামন্বয়ে ইতরেতরযোগঃ।' যথা-রামশ্চ লক্ষ্মণশ্চ গচ্ছতি।

ঘ) সমাহার- সমস্যমান পদগুলি পরস্পর সাহিত্য বোঝালে তাদের সমূহ কে সমাহার বলে। 'সমূহঃ সমাহারঃ।' যথা-অহয়শ্চ নকুলাশ্চ-অহিনকুলম্। সূত্র-"যেষাঞ্চ বিরোধঃ শাশ্বতিকঃ।"

  • এদের মধ্যে কোন্ কোন্ অংশ সমাসে প্রযুক্ত হয় এবং কেন?

এই চারটি চার্থের মধ্যে সমুচ্চয় ও অন্বাচয় অর্থ সমাসের উপযোগী নয়। 'ঈশ্বরং গুরুঞ্চ ভজস্ব'-এই বাক্যে একটি মাত্র 'চ'-শব্দ থাকায় 'ঈশ্বরং ভজস্ব' বললে 'গুরুঞ্চ'-এই অংশের জন্য আর আকাঙ্ক্ষা থাকে না বলে অসামর্থ্যহেতু ঈশ্বর ও গুরু শব্দের সমাস হল না।

অপরদিকে, একটি অপরটির আনুষঙ্গিক হলেও উভয়-ই দেবদত্তের সঙ্গে অন্বিত, কিন্তু  'ভিক্ষাম্ অট' বলবার পর অবশিষ্ট অংশের জন্য 'গাং চ আনয়' আর কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকে না বলে, এখানেও সমাস হতে পারে না। কিন্তু ইতরেতর এবং সমাহারে পরস্পর সাহিত্যরূপ সম্বন্ধ থাকায় সমাস হয়, আর সমুচ্চয় ও অন্বাচয়ে এরূপ কোনো সম্বন্ধ থাকে না বলে ঐ দুটি চার্থে সমাস হয় না। সেজন্য 'প্রয়োগরত্নমালা'য় সূত্রিত হয়েছে-'সমুচ্চয়ান্বাচয়য়োর্দ্বন্দ্বো নাস্তি।' 



  • ইতরেতর-যোগদ্বন্দ্ব ও সমাহারদ্বন্দ্বের মধ্যে পার্থক্যঃ-

১. ইতরেতর যোগে মিলিতের অন্বয় হয়। আর সমাহারে সমূহ অর্থ প্রকাশিত হয়। ফলে ইতরেতর-যোগদ্বন্দ্বসমাসে সমাসবদ্ধ পদ হয় দ্বিবচনান্ত নতুবা বহুবচনান্ত, কিন্তু সাহিত্য বোঝালে সমাহার নিত্য ক্লীবলিঙ্গ এবং একবচন হয়ে থাকে। দ্বন্দ্ব সমাসে উক্ত দ্বিবিধ ভেদ স্বীকার করে 'শব্দশক্তিপ্রকাশিকা'য় জগদীশ বলেছেন-

'দ্বৌ ভেদাবস্য শাস্ত্রোক্তৌ সমাহারেতরেতরৌ।

একান্যবচনাকাঙ্ক্ষাহীনোপাদানতশ্চ তৌ।।' 

সমাহার ও ইতরেতর ভেদ নিয়ে ভর্তৃহরি তাঁর বাক্যপদীয় গ্রন্থেে বলেছেন-

'ইতরেতরযোগস্তু ভিন্নসঙ্ঘাভিধায়িনাম্।

প্রত্যেকঞ্চ সমূহোসৌ সমূহিষু সমাপ্যতে।।' (3-14-30)

২. ইতরেতর যোগদ্বন্দ্ব সমাসে পরপদের লিঙ্গ অনুসারে সমাসবদ্ধ পদের লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। "পরবল্লিঙ্গং দ্বন্দ্বতৎপুরুষয়োঃ।"

কিন্তু সমাহার দ্বন্দ্ব সমাসে সমাসবদ্ধ পদ সর্বদা ক্লীবলিঙ্গ হয়। সূত্র-"স নপুংসকম্।"

৩. ইতরেতর যোগদ্বন্দ্ব বিকল্পে সমাহার দ্বন্দ্ব হয়ে যায়-'সর্বো দ্বন্দ্বো বিভাষয়ৈকবদ্ ভবতি।' যথা-বধূশ্চ বরশ্চ-'বধূবরৌ', আবার 'বধূবরম্' ও হয়ে থাকে।



সহায়ক গ্রন্থসমূহ--
ডঃসত্যনারায়ণ চক্রবর্তী প্রণীত পাণিনীয় শব্দশাস্ত্র।
ডঃবিশ্বরঞ্জনবেদব্যাকরণতীর্থ-সম্পাদিত বৈয়াকরণসিদ্ধান্তকৌমুদী।
ডঃসচ্চিদানন্দমুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত বৈয়াকরণসিদ্ধান্তকৌমুদী (সমাসপ্রকরণ)।
লাহিড়ী-শাস্ত্রি-সম্পাদিত পাণিনীয়ম্।


________________





Sunday, August 16, 2020

পাঠ- বহুব্রীহিসমাস ও তার প্রকারভেদ

"শেষো বহুব্রীহিঃ"(২-২-২৩) হল একটি অধিকার সূত্র। ইহার অধিকার "চার্থে দ্বন্দ্বঃ" (২-২-২৯) সূত্রের পূর্ব পর্যন্ত। "শেষো বহুব্রীহিঃ" (২-২-২৩) সূত্র হইতে "চার্থে দ্বন্দ্বঃ" (২-২-২৯) সূত্রের পূর্ব পর্যন্ত যে সমাস হয় তাহার বহুব্রীহি সমাস সংজ্ঞা হয়। "শেষো বহুব্রীহিঃ" সূত্রের ব্যাখ্যায় ভট্টোজি দীক্ষিত 'শেষ' শব্দের স্বরূপ সম্বন্ধে বলেছেন- ' "দ্বিতীয়া শ্রিতাতীত----"(২-১-২৪) ইত্যাদিনা যস্য ত্রিকস্য বিশিষ্য সমাসো নোক্তঃ স শেষঃ, প্রথমান্তমিত্যর্থঃ।' অর্থাৎ "দ্বিতীয়া শ্রিতাতীত.......", "তৃতীয়া তৎকৃতার্থেন....", "চতুর্থী তদর্থার্থ....", "পঞ্চমী ভয়েন.....," "ষষ্ঠী", "সপ্তমী শৌণ্ডৈঃ" ইত্যাদি সূত্রে 'দ্বিতীয়া', 'তৃতীয়া' প্রভৃতি বিভক্তির বিশেষ ভাবে উল্লেখ করে সমাস বিহিত হয়েছে, কিন্তু যে বিভক্তিটির বিশেষ উল্লেখ করে কোনো সমাস বিধান করা হয় নি, তাই এখানে শেষ। সুতরাং 'শেষ' বলতে প্রথমা বিভক্তিকেই বুঝতে হবে। 

সূত্রে 'শেষ'-র শাব্দিক অর্থ "উক্তাদন্য শেষঃ"। অর্থাৎ যা বলা হয়নি, যা বাকী রয়ে গেছে তাই শেষ। কাশিকাকার বামন-জয়াদিত্য বলেছেন- যেখানে অন্য কোনো সমাসের বিধান হয়নি তাই শেষ এবং সেখানেই বহুব্রীহি প্রযোজ্য- 'কঃ শেষঃ? যত্রান্যঃ সমাসো নোক্তঃ।'

এখানে উল্লেখ্য, কর্মধারয় সমাসও প্রথমান্ত পদে হলেও, কর্মধারয় সমাস বিধায়ক সূত্রে 'প্রথমা' উল্লিখিত নেই। কর্মধারয় সমাস বিধায়ক সূত্রটি হল-"বিশেষণং বিশেষ্যেণ বহুলম্।" অর্থাৎ বিশেষ্যের সঙ্গে বিশেষণের সমাস হয়।


বহুব্রীহি সমাসের প্রকারভেদ :-

বহুব্রীহি সমাসে সাধারণতঃ অন্য পদের অর্থ প্রধান হয়-'অন্যপদার্থপ্রধানো বহুব্রীহিঃ।' প্রধানতঃ সমানাধিকরণ ও ব্যধিকরণভেদে বহুব্রীহি দ্বিবিধ--

১) সমানাধিকরণ বহুব্রীহি- যে বহুব্রীহিতে সমস্যমান পদের অভিধেয় একটি মাত্র হয় এবং যেখানে পদগুলি পরস্পর বোধ্য-বোধকভাবে বা আশ্রয়-আশ্রয়ী ভাবে সম্বন্ধ থাকে তাকে সমানাধিকরণ বলে।  এককথায়, একাধিক প্রথমান্ত পদে বিশেষ্য-বিশেষণের বহুব্রীহি সমানাধিকরণ বহুব্রীহি। যেমন-'পীতম্ অম্বরং যস্য সঃ' পীতাম্বরঃ। এখানে 'পীতত্ব' ও 'অম্বরত্ব' অবিচ্ছিন্নভাবে একটি মাত্র আধারে পরস্পর আশ্রয়পূর্বক অবস্থান করছে বলে এরা সমানাধিকরণ হয়েছে। বিধায়ক-সূত্র--"অনেকমন্যপদার্থে।"

২) ব্যধিকরণ বহুব্রীহি- ব্যধিকরণ বহুব্রীহিতে কিন্তু সমস্যমান পদের অভিধেয় বস্তু  এক নয়। যেমন- 'বীণা পাণৌ যস্যাঃ সা' বীণাপাণিঃ। এখানে বীণাত্ব ও পাণিত্ব বিভিন্ন আধারকে আশ্রয় করে ব্যধিকরণ হয়েছে। 

ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সম্বন্ধে পাণিনি বিশেষ উপদেশ দেননি। বৃত্তিকারেরও মনে হয়, ব্যধিকরণ বহুব্রীহি অভিপ্রেত নয়- 'বহুব্রীহিঃ সমানাধিকরণানামিতি বক্তব্যম্।' কিন্তু ভাষাতে 'শরজন্মা', 'শাস্ত্রজন্মা', 'আত্মজন্মা' ইত্যাদি সৃষ্ট প্রয়োগ দৃষ্ট হয়। এরূপ দেখে বামনাচার্য তাঁর 'কাব্যালঙ্কারসূত্রবৃত্তি'-তে সূত্র করেছেন-'অবর্জ্যো বহুব্রীহির্ব্যধিকরণো জন্মাদ্যুত্তরপদঃ।' পরবর্তী বৈয়াকরণগণ ব্যধিকরণ বহুব্রীহির অপাণিনীয়ত্ব নিবারণের জন্য "সপ্তমীবিশেষণে বহুব্রীহৌ"-এই সূত্রের জ্ঞাপকতা স্বীকার করেছেন। দীক্ষিত বৃত্তিতে বলেছেন- 'অত এব জ্ঞাপকাদ্ ব্যধিকরণপদো বহুব্রীহিঃ।'

বাররুচসংগ্রহে বহুব্রীহি সমাসকে ছয় প্রকার বলা হয়েছে-'ষড্বিধশ্চ বহুব্রীহিঃ।' যেমন-তদ্গুণসংবিজ্ঞান, অতদ্গুণসংবিজ্ঞান, সংখ্যোত্তরপদ, অন্তরালাভিধেয়ক, সরূপোপলক্ষিত এবং সহপূর্বপদ। দৃষ্টিভেদে বহুব্রীহি আবার দ্বিবিধ হতে পারে, তদ্গুণসংবিজ্ঞান ও অতদ্গুণসংবিজ্ঞান বহুব্রীহি। চাঙ্গ সূত্রে উক্ত বিভাগ নিয়ে এই কারিকাটি দৃষ্ট হয়-'তদ্গুণোতদ্গুণশ্চেতি বহুব্রীহির্দ্বিধা মতঃ।' 

১) তদ্গুণসংবিজ্ঞান বহুব্রীহি- যে বহুব্রীহি সমাসের শাব্দবোধে সমস্যমান পদার্থেরও উপস্থিতি হয়, তাকে তদ্গুণসংবিজ্ঞান বলে। যথা--'লম্বৌ কর্ণৌ যস্য, তম্' - লম্বকর্ণম্ আনয়। এস্থলে 'আনয়ন' ক্রিয়ার সঙ্গে এরূপ বালক এবং কর্ণ উভয়েরই অন্বয় আছে।

২) অতদ্গুণসংবিজ্ঞান বহুব্রীহি- যে বহুব্রীহিতে শাব্দবোধে সমস্যমান পদের অতিরিক্ত পদার্থের উপস্থিতি হয় তাকে অতদ্গুণসংবিজ্ঞান বহুব্রীহি বলে। যথা-'দৃষ্টঃ সমুদ্রঃ যেন'-দৃষ্টসমুদ্রম্ আনয়। এই বাক্যে 'আনয়ন' ক্রিয়ার সঙ্গে ঐ বালকের অন্বয় আছে, কিন্তু সমুদ্রের অন্বয় নেই।

যাঁরা ষড্বিধ বহুব্রীহি স্বীকার করেন,পূর্বোক্ত 'তদ্গুণসংবিজ্ঞান' এবং 'অতদ্গুণসংবিজ্ঞান' উভয়ের সঙ্গে সূত্র বিশেষ বিহিত চারপ্রকার অবান্তর বিভাগ করে থাকেন, যথা-

৩) সংখ্যোত্তরপদ বহুব্রীহি- যে বহুব্রীহি সমাসের উত্তরপদ সংখ্যাবাচক হয়, তাকে সংখ্যোত্তরপদ বহুব্রীহি বলে। যথা -'দ্বৌ বা ত্রয়ো বা-দ্বিত্রাঃ।' সূত্র-"সংখ্যয়াব্যয়াসন্নাদূরাধিকসংখ্যাঃ সংখ্যেয়ে।"

৪) অন্তরালাভিধেয়ক বহুব্রীহি- যে বহুব্রীহি সমাসের দুটির দিকের অন্তরাল অর্থাৎ মধ্যবর্তী দিককে নির্দেশ করা হয়, তাকে অন্তরালাভিধেয়ক বহুব্রীহি বলে। যথা-'দক্ষিণস্যাঃ পূর্বস্যাশ্চ দিশোঃ অন্তরালং' -দক্ষিণপূর্বাঃ। সূত্র- "দিঙ্নামান্যন্তরালে।"

৫) সরূপোপলক্ষিত বহুব্রীহি-পরস্পর একপ্রকার ক্রিয়ানুষ্ঠান বোঝালে সমানাকার দুটি সপ্তম্যন্ত বা তৃতীয়ান্ত পদের বহুব্রীহি সমাস হয়, তাকে সরূপোপলক্ষিত বহুব্রীহি বলে। সূত্র-"তত্র তেনেদমিতি সরূপে।" এই সমাসে "ইচ্ কর্মব্যতিহারে" সূত্রানুসারে সমাসান্ত 'ইচ্'-প্রত্যয়ের বিধান হয়। এই সমাসের নামান্তর হল 'ব্যতিহার বহুব্রীহি।' "তিষ্ঠদ্গু-----" গণপাঠে ইচ্ প্রত্যয়ের পাঠ থাকায় 'ইচ্'-প্রত্যয়ান্ত শব্দ অব্যয়ীভাব এবং অব্যয় হয়।
উদাহরণ-
ক) সপ্তম্যন্ত-'কেশেষু কেশেষু গৃহীত্বা ইদং যুদ্ধং প্রবৃত্তম্'-কেশাকেশি
খ)  তৃতীয়ান্ত- 'দণ্ডৈশ্চ দণ্ডৈশ্চ প্রহৃত্য ইদং যুদ্ধং প্রবৃত্তম্'-দণ্ডাদণ্ডি

৬) সহপূর্বপদ-এই বিভাগকে আমরা তুল্যযোগ বহুব্রীহি ও বলে থাকি, কেননা বিধায়ক সূত্র -"তেন সহেতি তুল্যযোগে।" অর্থাৎ তুল্যযোগ বোঝালে 'তৃতীয়ান্ত' পদের সঙ্গে 'সহ' শব্দের বহুব্রীহি সমাস হয়। যথা-'পুত্রেণ সহ বর্তমানো যৎ সঃ' -সপুত্রঃ / সহপুত্রঃ

উপরন্তু বহুব্রীহি সমাসের অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য বিচার করে বহুব্রীহি কে আরও তিন প্রকার বলা যেতে পারে।

৭) নঞ্ বহুব্রীহি- নঞ্-এর পরে অস্ত্যর্থক শব্দ থাকলে পরবর্তী সুবন্ত শব্দের সঙ্গে তার বহুব্রীহি সমাস হয়। একে নঞ্ বহুব্রীহি বলে। প্রাসঙ্গিক বার্তিক সূত্র-"নঞোস্ত্যর্থানাং বাচ্যো বা চোত্তরপদলোপঃ।" যথা-'অবিদ্যমানঃ পুত্রঃ যস্য সঃ'-অবিদ্যমানপুত্রঃ/ অপুত্রঃ

৮) উপমানগর্ভ বহুব্রীহি- যে বহুব্রীহি সমাসের ব্যাসবাক্যে উপমানবোধক 'ইব' এবং উপমানের উল্লেখ থাকে তাকে উপমানগর্ভ বহুব্রীহি বলে। যথা- 'মীনস্য ইব অক্ষিণী যস্যাঃ সা'- মীনাক্ষী। সূত্র-"বহুব্রীহৌ সক্থ্যক্ষ্ণোঃ স্বাংগাৎ ষচ্।"

৯) প্রাদি বহুব্রীহি- প্র-প্রভৃতি উপসর্গের পরে ধাতু নিষ্পন্ন পদ থাকলে পরবর্তী সুবন্ত পদের সঙ্গে তার বহুব্রীহি সমাস হয় এবং ঐ ধাতুনিষ্পন্ন পদ বিকল্পে লুপ্ত হয়। যথা- 'বিগতঃ ধবঃ যস্যাঃ সা'- বিধবা /বিগতধবা। বার্তিক সূত্র- "প্রাদিভ্যো ধাতুজস্য বাচ্যো বা চোত্তরপদলোপঃ।"

পরিশেষে, আচার্য জগদীশ তাঁর 'শব্দশক্তিপ্রকাশিকা' গ্রন্থে বলেছেন-দ্বিপদ-ত্রিপদ-চতুষ্পদ ভেদে বহুব্রীহি বহুবিধ হতে পারে।

দ্বিপদ বহুব্রীহি-  'বহবঃ ব্রীহয়ঃ যস্য সঃ'-বহুব্রীহিঃ
ত্রিপদ বহুব্রীহি-  'চিত্রা জরতী গৌঃ যস্য'-চিত্রাজরদ্গুঃ
চতুষ্পদ বহুব্রীহি- 'দিব্যম্ অনেকম্ উদ্যতম্ আয়ুধং যস্য সঃ'-দিব্যানেকোদ্যতায়ুধঃ

বহুব্রীহি সমাস যে বহুপদ হবে তার উল্লেখ ভট্টোজি দীক্ষিত 'সর্বসমাসশেষ' প্রকরণে করেছেন-'অনেকপদত্বং দ্বন্দ্ববহুব্রীহ্যোরেব।'


সহায়ক গ্রন্থসমূহ--
ডঃসত্যনারায়ণ চক্রবর্তী প্রণীত পাণিনীয় শব্দশাস্ত্র।
ডঃবিশ্বরঞ্জনবেদব্যাকরণতীর্থ-সম্পাদিত বৈয়াকরণসিদ্ধান্তকৌমুদী।
ডঃসচ্চিদানন্দমুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত বৈয়াকরণসিদ্ধান্তকৌমুদী (সমাসপ্রকরণ)।
লাহিড়ী-শাস্ত্রি-সম্পাদিত পাণিনীয়ম্।


___________